AllBanglaNews24
প্রকাশিত: ১৬:৩৮, ১৭ জুলাই ২০২১

ছেড়ে দিতে হবে

ছেড়ে দিতে হবে

ছবি : সংগৃহীত

উপমহাদেশের কিংবদন্তি নায়িকা সুচিত্রা সেন তাঁর জীবনের একটি পর্যায়ে অভিনয় থেকে সরে দাঁড়ান। অভিনয় ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজেকে লৌকিক সমাজ থেকেও গুটিয়ে নেন। নিজেকে গুটিয়ে নেবার পরে জনসম্মুখে তাকে দেখা যায় নি আর। সুচিত্রা সেনের এই দর্শনের দিকটি গুরুত্বপূর্ণ।

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, মানুষ নিজেকে শাস্তি দেয় সস্তা করে দিয়ে। অর্থাৎ মানুষকে একথা জানতে হয় যে, কখন তাকে সরে যেতে হবে। সবসময় সবস্থানে নিজেকে প্রাসঙ্গিক ভাববার কোনো যুক্তি নেই। নিজেকে অপাঙতেয় করে শাস্তি দেওয়ার চেয়ে চেনা পরিসর ছেড়ে চলে যাওয়া ঢের ভালো। লালন সাঁঈয়ের গুরু সিরাজ সাঁঈ তাঁর দীক্ষায় বলছেন, সময়মত নিজেকে প্রকাশ করতে হয়, আবার প্রয়োজনে নিজেকে গুটিয়েও নিতে হয়।

একটি ইমেজ নিয়ে বেঁচে রইলেন সুচিত্রা। তাঁর যে দার্শনিক চিন্তা জনসম্মুখ থেকে তাকে নিভৃতবাসে নিয়ে গেল তিনি তাঁর সেই দর্শনের ওপরই থিতু রইলেন আমৃত্যু। ফলশ্রুতিতে তিনি চিরসবুজ সুচিত্রা সেন হয়েই পাকাপোক্ত অবস্থান নিলেন দর্শক হৃদয়ে। সুচিত্রা সেন বলতে যে চিরসবুজ ইমেজ তা তিনি নষ্ট হতে দেননি। একটি মৃত গাছ দেখলে যেমন পথিকের কষ্ট হয়, তেমনি মানুষের পতনও মানুষের জন্য দুঃখজনক। বিশেষত তিনি যদি প্রিয় মানুষ হন।

এই দার্শনিকচিন্তা আমাদের দার্শনিক শিক্ষকরা বুঝলে খুব সুন্দর হত। আমাদের শিক্ষকরা এই দার্শনিক বুঝ থেকে যোজন যোজন দূরে থাকেন বলে শিক্ষার মত একটি পরিবর্তনশীল বিষয় তাদের হাতে পড়ে বিভ্রান্ত হয়। ফলে শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষার্থীরা দিন দিন পিছিয়ে পড়ে। শিক্ষকরা নিজেরাও পিছিয়ে যান।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রবীণ শিক্ষকদের মুরুব্বিয়ানা আমাদের প্রয়োজন। তবে কোথায় তাদের প্রয়োজন এবং কোথায় তারা অপাঙতেয় তা আবিস্কার করার মুরদ থাকতে হবে। আমাদের বড় বড় জায়গাগুলো যদি আমাদের প্রবীণ শিক্ষকরা আঁকড়ে ধরে থাকেন তবে নতুন উদ্ভাবন ও নতুন জ্ঞানের প্রসার আটকে যেতে বাধ্য। শিক্ষার গতি মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। এই ক্ষতি শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য নয় বরং জাতীয় ক্ষতি এবং যা জাতীয় আয়ে আঘাত হানে।

সুচিত্রা সেনের মতো তারা যদি আমাদের হৃদয়ের আসন জয় করতে পারতেন তবে আরও উচ্চ আসনে তাদেরকে দেখতাম আমরা। অথচ তারা ক্ষমতার কাছে পরাজিত হন বলে, বড় চেয়ারের প্রত্যাশা করেন বলে তাদের পতন ঘটে। এ পতনের গতি তরান্বিত হয় যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গণ্ডি পেরিয়ে জানা-অজানা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হন। এবং এই পদ, পদবি ও পদক বাগাতে গিয়ে শেষ বয়সে বিসর্জন দেন নিজেদের বোধ-বুদ্ধি ও বিবেক। যে কথাটি যে স্থানে বলা দরকার তা তারা আর বলতে পারেন না। হারানোর ভয় তাদের পেয়ে বসে। উপরন্তু অনেক সহজ-সরল শিক্ষককে এইসকল পদে বসে অবসরকালীন ফলবান জীবনকেও নিষ্ফলা করে তোলেন।

শিক্ষকতার সঙ্গে প্রশাসনের দায়িত্ব যথাযতভাবে পালন সম্ভব নয়। একথা বুঝতে দার্শনিক হতে হয় না বা প্রশাসক হয়েও দেখতে হয় না।

প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপাচার্য বা বিভিন্ন কমিশনের বড় বড় পদগুলো-যেখান থেকে শিক্ষাকৌশল তৈরি হয়-এসব স্থানে আধুনিক চিন্তা-চেতনার তরুণ পণ্ডিতদের আসা উচিত। পক্ষান্তরে অবসর বয়সে এসকল বড় পদে গিয়ে অবসাদ-ক্লান্তিজনিত নিদ্রায় না ভুগে বাড়িতে আত্মীয়-পরিজন বেষ্টিত হয়ে সময় কাটাতে পারেন প্রবীণ শিক্ষকরা।

সুচিত্রা সেনের আলাপ দিয়ে শেষ করা যাক। মানুষের ইমেজ ধরে রাখার জন্য যে দার্শনিক ভিত্তি প্রয়োজন তা সম্ভবত আমরা তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছি। ফলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে খুব কম সংখ্যক মডেল তৈরি হচ্ছে। চার্লি চ্যাপলিন, মিস্টার বিন বা সুচিত্রা সেনের মত শিল্পীদের জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি বহুরৈখিক হয়। সম্ভবত সারাজীবন ধরে নানা চরিত্রে অভিনয় করতে করতে পৃথিবীকে দেখার যে যোগ্যতা তাদের তৈরি হয়-সেই যোগ্যতা দিয়ে তারা আমাদের কাছে নিদর্শন ও দৃষ্টান্ত তৈরি করেন। অথচ আমরা শিক্ষকরা দর্শনের পণ্ডিত হয়েও জীবন দর্শনে মানুষকে জাগ্রত করতে অনেকাংশে ব্যর্থ।

দিস্তা দিস্তা পিএইচডি গবেষণা করে আমরা যা বলতে পারি না, চার্লি চ্যাপলিন তার একটি সংলাপ বা অভিব্যক্তি দিয়ে তা বলে ফেলেন অনায়েসে। সুচিত্রা সেন তাঁর জীবন দিয়ে তা দেখিয়ে যান। তারা দেখিয়ে গেলেন, মানুষকে কখন সামনে থাকতে হয়, কখন যেতে হয় পর্দার আড়ালে। অথচ আমরা এই গুরুত্বপূর্ণ জীবন দর্শন বারবার বিস্মৃত হই।

শেয়ার করুন

Advertising
allbanglanewspaper-link

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়

    Add