গত কয়েক দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে ভাইরাল হয়েছে এক পুলিশ দম্পতির ছবি।
পোস্টটিকে ঘিরে প্রশংসায় ভাসছেন এই পুলিশ দম্পতি। চাকরি জীবনে স্ত্রীর পদমর্যাদা স্বামীর উপরে হলেও দাম্পত্য জীবনে তারা বেশ সুখি। পরস্পরের প্রতি ভালবাসা ও শ্রদ্ধাবোধের বিষয়টিই এতে প্রাধান্য পেয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন গ্রুপ ঘুরে দেখা যায়, গত বৃহস্পতিবার (১৮ মার্চ) সন্ধ্যায় বাংলাদেশ পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) উজ্জ্বল ঘোষ জিতু ও তার স্ত্রী পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) উর্মী দেবের ছবি তাদের ফেসবুকে পোস্ট করেন।
নিজের ভেরিফাই পেজ ও পোস্টে উপ-পরিদর্শক উজ্জ্বল ঘোষ জিতু লিখেন, ‘পুলিশিং পেশার ব্যাপারে যাদের একটু ধারনা আছে তারা বলতে পারবেন অবস্থানগত দিক থেকে আমার সহধর্মিণীর অবস্থান আমার থেকে কতটা উপরে। আমাদের বিয়ের পর আমাদের কারও চাকরি হয়নি। আমার আর আমার সহধর্মিণীর অবস্থানের এই আকাশ পাতাল পার্থক্যের তোয়াক্কা না করে এই দেবীতুল্য মানুষটা আমাকে আপন করে নিয়েছিলেন। যখন অহরহ পোষ্ট দেখি মেয়েরা লোভী হয়, মেয়েরা বিসিএস স্বামী খুঁজে পেলে সব ছাড়তে পারে, মেয়েরা টাকা আর অবস্থান ছাড়া আর কিছু বোঝে না আমার তখন খুব হাসি পায় মায়ের জাত নিয়ে কি আমাদের চিন্তাধারা এটা ভেবে। একজন বিসিএস কর্মকর্তা যে কিনা আমার মত একজন সামান্য মানুষকে এতটা আপন করে নিয়েছেন তিনিও তো একজন মেয়ে।’
উজ্জ্বল ঘোষ জিতু ও উর্মী দেবের বিয়ে হয়েছে ২০২০ সালের ৩০ নভেম্বর। নিজেদের পছন্দ হলেও তাদের বিয়ে হয়েছে পারিবারিকভাবে ধুমধামে।
এই বিষয়ে উজ্জ্বল ঘোষ জিতু বলেন, ‘আমাদের বাড়ি ফরিদপুর জেলা সদরে। পিতা ছিলেন একজন পরিবহন ব্যবসায়ী। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে বড়।’
জিতু জানান, উপ-পরিদর্শক পদে যোগদান করতে তিনি ট্রেনিং শুরু করেন ২০১৮ সালে ২৭ জানুয়ারিতে। পুলিশের ট্রেনিং শেষ করেন ২০১৯ সালে। এরআগে থেকেই এএসপি উর্মী দেবের সঙ্গে তার পরিচয় ছিল। গত ২০২০ সালের ২৮ জানুয়ারি উপ পরিদর্শক (এসআই) পদে চাকরি নিশ্চিত হয়। এরই মধ্যে দুইজনের মাঝে মাঝে আলাপ আলোচনা হয়। একপর্যায়ে একে অপরকে পছন্দ করেন। বিষয়টি যার যার পরিবারকে জানালে পরিবারের সদস্যরা আলাপের পর ২০২০সালের ৩০ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে হয়।
ফেসবুকে পোস্ট সম্পর্কে জিতু বলেন, ‘নিয়মিত অন্যান্য পোস্টের মতো ফেসবুকে পোস্টটি দিয়েছিলাম। তবে পোস্টটি এভাবে আলোচনায় আসবে বা ভাইরাল হবে আমি বুঝতে পারিনি। বিষয়টি মানুষ পজিটিভলি নিয়েছে। আবার কেউ কেউ নেগেটিভ মন্তব্য করছে। তবে যে যাই বলুক, পুলিশিং এর বাহিরে ব্যক্তিগত জীবনে আমরা অনেক সুখী।’
জিতু বলেন, ‘আমার স্ত্রীও খুব ভাল মানুষ। তার সততার কোন কমতি নেই। আমার মতো একজন নগণ্য মানুষকে বিয়ে করে বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি আসলেই কতটা নির্লোভ ও নিরহংকার।’
জিতু বলেন, ‘নারী বা পুরুষ নয়। এভাবে যদি প্রত্যেকে যার যার স্থান থেকে এগিয়ে আসেন তাহলে সমাজ বদলে যাবে। সামাজিক বেড়াজালে আটকে থাকা কুসংস্কার আর অহংকার নামক ব্যাধির পতন হবে। সামাজিকতা এবং সমাজের মান আরো বৃদ্ধি পাবে।’
বর্তমানে তিনি কুমিল্লা জেলার মীরপুর হাইওয়ে পুলিশে কর্মরত আছেন। তিনি তাদের দাম্পত্য জীবনের জন্য সবার আর্শিবাদ কামনা করেন।
এসআই উজ্জ্বল ঘোষের স্ত্রী বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া রেলওয়ে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) উর্মি দেব বলেন, ‘আমার পৈত্রিক নিবাস চট্রগামে। আমার বাবা একজন আইনজীবী। আমার এক ভাই ও এক বোনের মধ্যে আমিই সবার বড়। বিসিএস এর পর এএসপি পদে চাকরি জীবনের প্রথম পোস্টিং আখাউড়া সার্কেলেই। ছবিটি সে (স্বামী) আমার অফিসে এসে তুলেছিল।’
উর্মি দেব বলেন, ‘আমার স্বামীর সঙ্গে চাকরিতে যোগদান করার পর পরিচয়। কর্মজীবন আর আমাদের ব্যক্তিগত জীবন আলাদাভাবে চালাতে হয়৷ যেন একটির কারণে আরেকটি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। একই পেশায় দুইজন থাকায় ভাল হয়েছে। কারণ একজন আরেক জনেরটা সহজে বুঝতে পারি।’
এক প্রশ্নের জবাবে এএসপি উর্মিদেব বলেন, ‘আমরা যখন বিয়ে করি তখন দুইজনই চাকরিজীবী। আমরা বুঝে শুনেই বিয়েতে সম্মত হয়েছি। তাই আমাদের কোন সমস্যা হবে না বলে আশা করছি। তারপরও সাংসারিক জীবনে প্রতিটি দম্পতির ব্যক্তিগত কিছু সমস্যা হতে পারে। আশা করছি এসব বিষয় আমরা দুইজন আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার চেষ্টা করে যাব।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে উর্মি দেব বলেন, ‘কোন একটি সম্পর্ক যখন পরিণতি পায়, তাহলে অবশ্যই ভাল লাগার বিষয়। আমাদের জীবন একটি, সব কিছু হিসাব-নিকেশ করে করা যায় না। বৃহৎ স্বার্থের জন্য ক্ষুদ্র বিষয়গুলো পরিহার করতে হয়। শিক্ষিত মানুষ হয়ে যদি দৃষ্টিভঙ্গি না পাল্টাই, তাহলে কে পাল্টাবে? সবার আগে নিজের মনমানসিকতা বদল করতে হবে। তাহলে সমাজ বদলে যাবে।’
এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পুলিশ দম্পতির ছবি ভাইরাল হওয়ার পর অনেকের দৃষ্টিতে পরেছে। ফেসবুক স্ট্যাটাসটি নিয়ে বেশিরভাগই ইতিবাচক আলোচনা করেছেন।
এ ব্যাপারে আখাউড়া পুজা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক বিশ্বজিৎ পাল বলেন, ‘আমি পুলিশ কর্মকর্তা উর্মিদেবকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তিনি আমাদের আখাউড়া রেলওয়ে পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার। গত কয়েকদিন ধরে ফেসবুকে তার এবং তার স্বামীর ছবিগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে ঘটনা যাই হউক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে এই দম্পতির মন মানসিকতা যে যথেষ্ট, এটাই তার জ্বলন্ত উদাহরণ। তাই আমি বলবো দৃষ্টিভঙ্গি বদলে ফেলুন সমাজ বদলাবে।’
